মোঃ ইকরামুল হক রাজিব
বিশেষ প্রতিনিধি
সুন্দরবনে চলমান তিন মাসের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও থেমে নেই হরিণ শিকার। বনের চারপাশে একটি নতুন ভোক্তা শ্রেণির উত্থানের ফলে হরিণের মাংসের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। এতে করে সুসংগঠিত শিকারি চক্রগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিতে তারা নিচ্ছে নিত্য নতুন কৌশল। দৃশ্যমান নাইলনের রশির পরিবর্তে তারা এখন ব্যবহার করছে স্টেইনলেস স্টিলের তার, যা সুন্দরবনের আলো-ছায়ার পরিবেশে প্রায় অদৃশ্য।
বন বিভাগের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি চেতনানাশক স্প্রে টোপ হিসেবেও ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মোংলা, রামপাল, খুলনার দাকোপ এবং বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় একাধিক পেশাদার হরিণ শিকারি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা জেলে সেজে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি খণ্ড খণ্ডভাবে বনে নিয়ে যায় এবং পরে সেগুলো একত্র করে ফাঁদ তৈরি করে। শিকারের পর সেইসব সরঞ্জাম নির্দিষ্ট গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখে পরবর্তী ব্যবহারের জন্য
স্থানীয় মৌয়াল, জেলে, কাঁকড়া সংগ্রাহক এবং হরিণ শিকার ছেড়ে দেওয়া কয়েকজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এই চোরাকারবার চালানো হয়।
১ জুন থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও বর্তমানে সুন্দরবন জুড়ে হরিণ শিকারের ফাঁদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গত দেড় মাসে বন বিভাগ ৪২ কেজি হরিণের মাংস, তিনটি হরিণের কাটা মাথা উদ্ধার করেছে। একই সময় ৬,১১২টি ‘হাটা’ ফাঁদ, ১৭৮টি ছিটকা ফাঁদ অপসারণ করা হয়েছে, যেগুলো পরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সাতটি মামলা এবং ইউডিওআর ১৬টি ও ওসিআর ১১টি মামলা রুজু হয়েছে। এছাড়া অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে ২৯ জনকে আটক এবং ২৭টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও নৌকা জব্দ করা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী শ্রেণি শিকারিদের পক্ষে কাজ করছে। সর্বশেষ তিন দিনে ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে, যদিও তারা নিজেদের মাছ চোর বলেই দাবি করেছে। তবে তাদের হরিণ শিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা তদন্ত করা হবে।
সুন্দরবনের আশপাশের মাছের ডিপো ও শুটকির দাদনদারদের সহায়তায় জেলেরা হরিণ শিকারিতে পরিণত হয়। বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তারা পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের অধীনে চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে শিকারচক্রে জড়িত ১৫০ জন ব্যক্তির একটি হালনাগাদ তালিকা তৈরি করেছেন এবং মনিটরিং করছেন।
তথ্য অনুযায়ী, শিকারিরা বনভূমির অবস্থান সম্পর্কে অত্যন্ত অভিজ্ঞ হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বুঝতে পারলে মুহূর্তেই গহীন অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে, ফলে তাদের আটক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জের আওতায় সোনাতলা, পূর্ব খুড়িয়াখালী, দাসের ভাড়ানী, চরদুয়ানী, জ্ঞানপাড়া, কাঁঠালতলা গ্রাম ছাড়াও রামপাল, মোংলা ও দাকোপ উপজেলায় অনেক শিকারচক্র সক্রিয় রয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে— জ্ঞানপাড়া: জাকির বিশ্বাস চরদুয়ানী: মালেক গোমস্তা, মো. সুবান বিশ্বাস পাইকগাছা: শওকত খান হরিণপয়েন্ট, কটকা ও সুপতি অঞ্চলে: বাদল হাওলাদার, হোসেন আলী গাজী, রণকুল গাজী।
চাঁদপাই রেঞ্জের আওতায় মোংলা, ঢাংমারি, ভোজনখালী ও আশপাশের অঞ্চলগুলোতেও বেশ কিছু চক্র সক্রিয়। এরা জেলে বা মৌয়াল সেজে বনে ঢুকে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছু রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি এই চোরাশিকারে মদদ দেন। বিশেষ অনুষ্ঠান, আপ্যায়ন বা ঘুষ হিসেবে হরিণের মাংস ব্যবহৃত হয়। ১,২০০–১,৮০০ টাকা কেজি দরে এই মাংস বিক্রি হয়, অনেক সময় চামড়াসহ মাংস কেটে পাঠানো হয়। একটি অবৈধ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে যার মাধ্যমে সিন্ডিকেট সদস্যরা সহজেই মাংস সংগ্রহ করতে পারে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, "শিকারিরা নিত্য নতুন কৌশল নিচ্ছে, পুরো সুন্দরবনে ফাঁদ পেতে রেখেছে। বনরক্ষীরা ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে এসব ফাঁদ সরাচ্ছেন। বাঘ, কুমির ও সাপের ভয় থাকলেও তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
তিনি জানান, কচি পাতা বা ডালে চেতনানাশক স্প্রে দেওয়া হলে সেগুলো নদীতে ফেলে দেওয়ার বা মাটিতে পুঁতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’-এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “প্রতি বনরক্ষীকে প্রায় ১,৮০০ হেক্টর বন পাহারা দিতে হয়—এটা বাস্তবসম্মত নয়। বন রক্ষা করতে হলে জনগণের সচেতনতা, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমানোর উদ্যোগ জরুরি।
দৈনিক গণকথা / সম্পাদক ও প্রকাশক
মোঃ তরিকুল ইসলাম কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত
বাগেরহাট প্রধান কার্যালয়:
বাসস্ট্যান্ড আল আমিন হোটেল এর নিচে বাগেরহাট
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত